আপনি-আমি, হিরো আলম এবং আন্না হাজারে সমাচার

আপনি-আমি, হিরো আলম এবং আন্না হাজারে সমাচার

একটা সময়ে এদেশের মানুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বা বেগম রোকেয়া সাখাওয়াতকে নিয়ে আলোচনা করতো। চায়ের টেবিলে ঝড় উঠত নজরুলের কবিতা নিয়ে , পাড়ার আড্ডায় বিতর্ক সৃষ্টি হত আহমেদ ছফার কোন লেখাকে ঘিরে। তখনকার সময়ে রাজা রামমোহন রায় কিংবা সৈয়দ আমির আলীর মত সমাজ সংস্কারকরা ছিলেন সুপরিচিত এবং মানুষের আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে। বর্তমান সময়ে আমরা ‘সেলিব্রেটি’ বলতে যাদের বুঝিয়ে থাকি, তখনকার ‘সেলিব্রেটি’ ছিলেন তারাই।

সময় বদলেছে। এখনকার মানুষের আগ্রহ হিরো আলম বা সেফু দা’কে নিয়ে। পিপিলিকা সার্চ ইঞ্জিনের তথ্যমতে ইন্টারনেটে হিরো আলমকে নিয়ে আলোচনা হয়েছে কমপক্ষে ৫৭৬,৩৩০ বার। হিরো আলম এখন মানুষের আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে।

হিরো আলমকে নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। সেইসব বিতর্কে হিরো আলমের পক্ষে যেমন অনেকে রয়েছে তেমনি বিপক্ষেও আছে অনেকে। একজন স্বাধীন নাগরিক হিসাবে হিরো আলম অনেক কিছুই করতে পারেন, সেই অধিকার তার রয়েছে। আর হিরো আলমের কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করা অথবা হিরো আলমকে নিয়ে নিন্দায় মেতে উঠার স্বাধীনতাও আপনার-আমার রয়েছে, তবে প্রশ্ন হচ্ছে হিরো আলম কি অনুসরন করার মত কেউ? অর্থাৎ তার কর্মকাণ্ড অনুসরন করে কেউ কি সুপথগামী হতে পারে অথবা সামাজিক অবক্ষয় থেকে উত্তরন পাওয়া যায়?   

হিরো আলম বিতর্কে অনেকেই মনে করেন হিরো আলমের কর্মকাণ্ড তরুন সমাজকে সুপথের দিশা না দিলেও অশ্লীলতা আর সামাজিক অবক্ষয় ঠিকই ছড়াচ্ছে। ইন্টারনেটের এই যুগে সুপরিচিত হয়ে উঠা কঠিন কিছু নয়। হিরো আলম বা সেফু দা’র মত অনেকের ভিডিও এখন মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে উঠে। সমাজ মেতে উঠে সেই ভাইরাল হওয়া কনটেন্ট নিয়ে, আর তারা হয়ে যান সুপরিচিত মুখ , সেলিব্রেটি !

সুপরিচিত মানেই কি সুপথগামী ? সুপরিচিত মানেই কি অনুসরণযোগ্য ? এডলফ হিটলার অথবা মীর জাফর আলী খাঁ’র মত মানুষেরাও কিন্তু সুপরিচিত ! তাদের সুপরিচিতি ইতিহাসের পাতায় যত্ন করে লেখা আছে।

হিরো আলমের প্রসঙ্গ আসলেই যার কথা সবথেকে বেশী মনে পরে, তিনি আমাদের পাশের দেশেরই নাগরিক। তিনি ভারতের সমাজ সংস্কারক আন্না হাজারে। তিনিও হিরো আলমের মতই জন্মগ্রহণ করেছিলেন প্রত্যন্ত গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে। ভারত সরকারের পদ্মশ্রী ও পদ্মভূষণ উপধি পাওয়া এই জীবন্ত কিংবদন্তী একজন সুপরিচিত মানুষ, সেলিব্রেটিও বটে। ভারতের মানুষেরা তাকে নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠেন।ভারতের তরুণদের কাছে তিনি জীবন্ত আইকন !

সেনাবাহিনীর সামান্য ড্রাইভারের চাকরি থেকে স্বেচ্ছা অবসরে গিয়ে তিনি  আহমেদনগর জেলার রালেগণ সিদ্ধি গ্রামের গ্রামবাসীদের মদ্যপানের নেশা ছাড়াবার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলেন, নিজেকে নিবেদিত করেন গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের আন্দোলনে। ২০০০ সালে তার ডাকে সারা দিয়ে ভারতবাসীরা কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে শক্তিশালী তথ্য অধিকার আইন পাশ করতে বাধ্য করায়। ২০১১ সালে অন্না হজারে দুর্নীতিমুক্ত ভারত গড়ার প্রত্যয়ে অধিক শক্তিশালী দুর্নীতি-বিরোধী লোকপাল বিল পাস করানোর জন্য আন্দোলন শুরু করেন।

আন্না হাজারেও একজন সেলিব্রেটি, সুপরিচিত ব্যক্তি। এই উপমহাদেশের অতীতের অনেক সমাজ সংস্কারকদের মত তিনিও অনুসরণীয়। তবে আমাদের দুর্ভাগ্য তিনি আমাদের দেশের কেউ নন। আর আমরা হয়তো তার মত  যারা রয়েছে তাদেরকে নিয়ে আলোচনা করতেও ভালবাসি না। একারনেই এদেশে পলান সরকরের মত 'সাদা মনের মানুষ' আমাদের কাছে সুপরিচিত নন। মানুষের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে বিনামূল্যে বই বিতরণ করলেও এরকম আলোর ফেরিওয়ালাতাদের নিয়ে আমরা আলোচনা করি না, তাই তারা আমাদের কাছে সিলিব্রেটিও হয়ে উঠতে পারেন না। তারা পৃথিবী থেকে বিদায় নেয় নীরবে, নিভৃতে। তারা সমাজে আলো ছড়িয়ে যায় গোপনে-অন্তরালে, আর আমরা ব্যস্ত হয়ে পরি সেফু দা অথবা হিরো আলমকে নিয়ে।

কোন সমাজে সুপরিচিত বা সেলিব্রেটি কারা হবেন সেটা নির্ধারণ করে সেই সমাজের বাসিন্দারাই। আমাদের অনন্তহীন আলোচনাই  সেফু দা অথবা হিরো আলমকে সেলিব্রেটি বানায়, আর আমাদের উপেক্ষা- অবহেলাই পলান সরকারকে পর্দার আড়ালে নিয়ে যায়।

হয়তো আমরাই চাইনা আলো ছড়িয়ে পড়ুক, তাই বাতিটাকে দূরে ঠেলে দেই, আর মেতে উঠি অর্থহীন অবক্ষয়কে আনন্দদের উপসর্গ ভেবে। এটাই কি আমাদের পরিচয়? আমাদের অবচেতন মনের সুপ্ত আশা ? তাহলে কি আমরা এমন সমাজই চাই যেখানে সেলিব্রেটি হবেন সেফু দা অথবা হিরো আলম আর অযত্নে অবহেলায় আলোর পথিক পলান সরকারের মত মানুষেরা বিস্মৃত হবে পর্দার আড়ালে?